Tuesday, 8 July 2014

এক মুঠো ছোটবেলা


"না মেঘা, ওই জামা টার জন্য ৬০০ টাকা বড্ড বেশি", ঠোট উল্টে মেঘা দোকানের টুলের ওপরে গিয়ে বসল। "এই দেখ, এটা কত সুন্দর..নিবি?", মা জিজ্ঞেস করল, "তোমার যেটা ইচ্ছে নাও", বিরক্তি সহকারে জবাব এল। আড়ঁ চোখে সে দেখে নিল তার মা কোন জামা টা পছন্দ করেছিল। সাদার ওপর ক্ষুদে ক্ষুদে গোলাপি ফুলের ছাপ। পেছনে বাধার বেল্ট টা পুরো গোলাপি। এত বড় হয়ে টিপিকাল মেয়েদের ফ্রক? বুকের জায়গা তে হানি কম্ব করা। কোমরের নিচ থেকে কিছু টা ঘের রয়েছে। মা যখন তাকে প্যাকেট টা দিল, সে টুক করে জামার গায়ে প্রাইস ট্যাগ টা দেখে নিল। ৩২৫ টাকা।

মা বাবা সব সময় তাকে পয়সার মূল্য শেখাতে চাইতেন। কিন্তু তার ১০ বছরের মন কি সেটা মানে? টাকা তো খরচা করার জন্যই তৈরি, তাহলে কিসের এত দ্বিধা? মেঘার গোমড়া মুখ টা দেখে মা গোলাপি সুতো দিয়ে জামার এক কোনায় তার নাম টা সেলাই করে দিল। ছোটবেলা থেকেই মেঘা সাজ গোজ এর পোকা। মা' অনুপস্থিতি তে লিপ্সটিক পরা, চুলে খোপার কাটা লাগানো, আর তার প্রিয় লাল সোনালি ওড়না কে শাড়ি করে পেঁচিয়ে "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে" তে নৃত্য। টিপ টা অবশ্য ওপরের তাকে থাকত বলে সে বাধ্য হয়ে স্কেচ পেন দিয়ে কাজ চালাত। "বড় হয়ে কি হতে চাও বাবু ?", এই প্রশ্নে গাদা গুচ্ছের ডাক্তার, টিচার, অভিনেত্রী শোনা যেত, কিন্তু মেঘার এক্টাই উত্তর ছিল, "এমন কিছু করব যাতে দাম না দেখেই সব কিনতে পারি"

সেই দিনের আজ ১৭ বছর হল। মেঘা শহরের এক নামী দামী পত্রিকার এডিটার হিসেবে চাকরি করে। বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ না করে এই টুকু বলা যথেষ্ট যে তার ১০ বছর বয়সের স্বপ্ন আজ সম্পূর্ণ। মা বাবার গাড়ি থেকে শুরু করে তার ওয়াক ইন ক্লসেট, বছরে দুবার বেড়াতে যাওয়া থেকে তার নতুন সোনার চিক, মেঘা যত টা বিলাসপ্রিয় ততটাই খরুচে। তিন মাসের মাথায়ে তার বিয়ে। মারাত্মক এলাহি ভাবে সব আয়জন চলছে। বাড়ির ছাদে গায়ে হলুদ, মেহেন্দি নাচ গানের জন্য হল ভাড়া, আর স্টার বিয়ে রিসেপসন দুটই। পাচঁ টা উপলক্ষে পাচঁ টা পোশাক। মেঘার সব কেনা কাটা ব্যবস্থা শেষ, শুধু বিয়ের বেনারসি টা বাকি। সবচেয়ে ভালো জিনিস টা তো সবচেয়ে শেষেই হয়, তাই না? বাজেট ছিল ২০০০০ টাকা।

এক বুধবার দেখে মেঘা হাফ ডে নিয়ে বেরিয়ে পরল বেনারসির খোজে। প্রচুর দোকান বাজার ঘোরা হল, অনেক অসাধারন শাড়ি দেখা গেল, তবু তার মন ছুয়ে গেল এরম কিছু সে পেল না। তখন প্রায় পাচঁ টা বাজতে যায়। মা তাকে বলে দিয়েছিল যে দিন এর আলো ছাড়া শাড়ি টা না কিনতে, অন্ধকার হলে আসল রংটা বোঝা যায়ে না। হতাশ হয়ে সে গাড়িতে উঠল। বাড়ির কাছাকাছি যখন, মেঘা তাকে দেখতে পেয়ে থামল।

হাতে একটা লিটার এর খালি কিন্লের্ বোতল, পা ফাকাঁ, চুল এলো মেলো, রাস্তার ধারে বসে সে জল ভরছিল। তবে মেঘার নজর শুধু একটা জিনিস এর উপর ছিল। ছোটবেলার এক দিন এর ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সপ্তমী দিন এর পূজো ছিল, মেঘা চোর হয়ে সোফার পেছনে লুকিয়ে। বাবাই, তার কাকার ছেলে কে আসতে দেখে সে পালাতে গেল, কিন্তু বাবাই লাফ দিয়ে তার জামা তে এমন টান মারল যে এক দিকের বেল্ট টা ছিঁড়ে তার হাথে চলে গিয়েছিল। বেল্ট টা গোলাপি রং এর ছিল। মেঘার ঘোর ভাঙল, সে ভুরু কুচকে দেখল। এখন গোলাপি টা সাদা হয়ে গেছে। কলের জলে ভেজা মাটিতে সে একলা একলা আপন মনে লুটোপুটি খাচ্ছে। গায়ের সাদা টা বেশ নীলচে, ফুল গুল প্রায় অদৃশ্য। বুক এর জায়গা তে প্রচুর ছেঁড়া সুতো। মেঘা মাথা নাড়িয়ে নিজের অস্বাভাবিক চিন্তা কে উড়িয়ে দিতে চাইল। কিন্তু তার মন রাজি হল না। মেয়েটির জল ভরা শেষ, সে উঠে দাঁড়ানো তে মেঘার চোখ আপনে আপ জামার নিচের বাঁদিকের কোণে চলে গেল। কয়েক্টা কালি মাখা গোলাপি সুতো যেন হেসে হাত নেড়ে তার নাম ধরে ডাকল - মেঘা

মেঘা গাড়ী থেকে নেমে, অস্পষ্ট দৃশ্যে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল... আধ্ ঘনটা পর সে বাড়ি ঢুকল, হাথের মুঠোতে তার ছোটবেলা কে ধরে, মুখে এক গাল হাসি। মূল্য দিয়ে প্রাপ্ত করা বটে, কিন্তু সেই জামার যদি আজ প্রাইস ট্যাগ থাকত, তাহলে মেঘার কাছে তার একটাই উপযুক্ত দাম হত - প্রাইসলেস বেনারসিরর বাজেট এখন ১০০০০ টাকা।

(Picture Courtesy: Internet)

No comments:

Post a Comment